যকৃত ক্যান্সার

সংক্ষিপ্ত বিবরণ

লিভার বা যকৃত মানবদেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং এটির অবস্থান উদরের উপরে, ডান দিকে। শরীরের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিপাকীয় কাজে ভূমিকা রাখে যকৃত। যকৃতের বিভিন্ন রোগের মধ্যে এর ক্যান্সার অন্যতম যা এর বিভিন্ন অংশকে প্রভাবিত করতে পারে। যকৃতের কোষগুলোকে হেপাটোসাইট বলা হয় এবং হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা (হেপাটোমা) যকৃত ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ ধরণের যা হেপাটোসাইটে শুরু হয়। ইন্ট্রাহেপাটিক (যকৃতের অভ্যন্তরীণ) কোলাঙ্গিওকার্সিনোমা এমন এক ধরনের ক্যান্সার যা পিত্ত নালীতে শুরু হয় এবং পরে যকৃতে ছড়িয়ে পড়ে। অ্যাঞ্জিওসারকোমা এবং হেম্যানজিওসারকোমা বিরল দুটি ক্যান্সারের উদাহরণ যা যকৃতের রক্তনালীগুলোকে আবৃত রাখা কোষগুলোকে আক্রমণ করে। আরো একটি বিরল ক্যান্সার হলো হেপাটোব্লাস্টোমা যা চার বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে। 

 

প্রধান কারণ

দীর্ঘদিন ধরে হেপাটাইটিস বি বা সি রোগে আক্রান্ত থাকলে যকৃত বা লিভার ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। বাংলাদেশে যকৃত ক্যান্সারের বিস্তারের জন্য হেপাটাইটিস বি ৬৬ শতাংশ দায়ী [১] । অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে রয়েছে অ্যালকোহল বা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শের কারণে যকৃতের সিরোসিস সৃষ্টি হওয়া যেখানে ক্ষতযুক্ত টিস্যু গঠিত হয় ও যকৃতে ছড়িয়ে পড়ে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বা অত্যধিক আয়রনযুক্ত ব্যক্তিরাও এ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছে। 

 

সংক্ষিপ্ত বিবরণ

লিভার বা যকৃতের ক্যান্সারের জন্য বেশ কয়েকটি স্টেজিং বা চিহ্নিতকরণের উপায় আছে এবং সকল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক একই পদ্ধতি ব্যবহার করেন না। চিকিৎসকরা লিভার ক্যান্সারগুলোকে যথাযথ চিকিৎসার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণরূপে কেটে ফেলা যায় কিনা তার ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করেন। 

রোগীর রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করার জন্য লিভার ক্যান্সার সাধারণত শারীরিক পরীক্ষা, বায়োপসি এবং আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি বা এমআরআই স্ক্যান ইত্যাদি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়। এই পর্যায়কে ক্লিনিকাল স্টেজ বলা হয়। এই পর্যায়ে রোগীর শরীরে অস্ত্রপচারের পূর্ববর্তী সকল পরীক্ষা করা হয়। যদি অস্ত্রপচার (সার্জারি) করা হয় সেক্ষেত্রে সার্জিকাল স্টেজ বা প্যাথলজিক স্টেজ নির্ধারণ করা হয় অস্ত্রপচারের সময় অপসারণ করা টিস্যু পরীক্ষণের মাধ্যমে। 

যকৃত বা লিভার ক্যান্সারের প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যায়গুলো টিউমারের আকার, সংখ্যা এবং এটি রক্তনালী ও লসিকাগ্ৰন্থিতে ছড়িয়ে পড়েছে কিনা তার উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। প্রাথমিক পর্যায় ইঙ্গিত করে একটি টিউমার যা রক্তনালী এবং লিম্ফ নোড বা লসিকাগ্ৰন্থিতে আক্রমণ করেনি। প্রথম পর্যায়ের প্রথম দিকের টিউমারগুলো আকারে ২ সেন্টিমিটারের কম এবং পরের দিকের গুলো ৪ সেন্টিমিটারের চেয়ে কম হয়ে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায়ের একটি মাত্র টিউমার দেখা যায় যা আকারে ২ সেন্টিমিটারেরও কম এবং রক্তনালীতে তৈরি হয় অথবা একাধিক টিউমারের উপস্থিতি দেখা যার কোনোটিই আকারে ৫ সেন্টিমিটারের বেশি নয়। তৃতীয় পর্যায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ নির্ধারণ করা হয় ৫ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় আকারের টিউমার বা যকৃতের প্রধান (পোর্টাল বা হেপাটিক) শিরাতে তৈরি হওয়া যেকোনো আকারের একটি টিউমার। চতুর্থ পর্যায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ নির্ধারণের জন্য নিকটবর্তী লসিকাগ্ৰন্থি (প্রথম ধাপের ক্ষেত্রে) ও হাড় বা ফুসফুসের মতো দূরবর্তী (দ্বিতীয় ধাপের ক্ষেত্রে) অঙ্গগুলোতে ক্যান্সারের বিস্তৃতি পরীক্ষা করা হয়। 

অন্যান্য চিহ্নিতকরণ পদ্ধতির মধ্যে সিরোসিস চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি (চাইল্ড-পুগ স্কোর) একটি যা রক্ত পরীক্ষা ও যকৃতের কার্যকারিতা নিরীক্ষণের উপর ভিত্তি করে ক্যান্সার চিহ্নিত করে। 

 

লক্ষণ 

লিভার ক্যান্সারে কোনো প্রাথমিক লক্ষণ নাও থাকতে পারে। পরবর্তীতে আক্রান্ত ব্যক্তি ওজন এবং ক্ষুধা হারাতে পারে, একই সাথে দুর্বল ও ক্লান্ত বোধ করতে পারে। অন্যান্য লক্ষণগুলির মধ্যে জন্ডিস, ফোলা পেট, বমি ও বমি ভাব অন্তর্ভুক্ত। দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বা সিরোসিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্বাভাবিকের চেয়ে খারাপ অনুভব করতে পারে বা তাদের লিভারের কার্যকারিতা পরীক্ষায় পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। এই লক্ষণগুলো ক্যান্সারের উপস্থিতি ইঙ্গিত করে না। তবে সনাক্ত হওয়ার সাথে সাথেই উপযুক্ত পরামর্শের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। 

 

সাধারণ চিকিৎসা পরিকল্পনা

লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে শল্য চিকিৎসা, টিউমার কেটে ফেলা বা  নিরসন, এম্বোলাইজেশন থেরাপি, বিকিরণ (রেডিয়েশন) থেরাপি, টার্গেটেড ড্রাগ থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি। সাধারণত চিকিৎসার পরিকল্পনাগুলো করা হয় লিভার সম্ভাব্যরূপে পুনরুদ্ধারযোগ্য (এক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের সময় টিউমারটি কেটে নেওয়া হয়) বা প্রতিস্থাপনযোগ্য কিনা তার উপর ভিত্তি করে। যে টিউমার থেকে ক্যান্সার সৃষ্টি হয়েছে তা অস্ত্রোপচারের যোগ্য কিনা অর্থাৎ যেটি শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েনি অথবা ক্যান্সারটি শরীরে ছড়িয়ে পড়ায় তা অস্ত্রোপচার সম্ভব কিনা এসব পরিস্থিতির উপরও চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে। 

রিসেকটেবল (যা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা সম্ভব) টিউমার: ক্যান্সারটি ছড়িয়ে না পড়লে, সহজেই অপারেশনযোগ্য হলে এবং রোগী সুস্থ থাকলে আংশিক হেপাটেক্টোমি (ক্যান্সার আক্রান্ত যকৃত বা লিভারের অংশ অপসারণ) করা যেতে পারে। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষাকালীন সময়ে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অন্যান্য বিকল্প পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে এ্যাবলেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্যান্সার-আক্রান্তদের লিভার টিস্যু ধ্বংস করা বা এম্বোলাইজেশন পদ্ধতির সাহায্যে সরাসরি ধমনীতে ইনজেকশন প্রয়োগ করে টিউমারে রক্ত প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত বা বন্ধ করা। অ্যাবলেশন পদ্ধতিতে টিউমারগুলো অপসারণ না করে রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি, মাইক্রোওয়েভ, ফ্রিজিং (ক্রায়োব্লেশন), বা অ্যালকোহল (পারকিউটেনিয়াস ইথানল ইনজেকশন) ব্যবহার করে ধ্বংস করা হয়। 

অস্ত্রোপচারের অযোগ্য টিউমার যা ছড়িয়ে পড়ে নি: চিকিৎসা পদ্ধতি গুলোর মধ্যে এ্যাবলেশন বা বিমোচন এবং/অথবা এম্বোলাইজেশন, টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, পদ্ধতিগতভাবে বা হেপাটিক আর্টারি ইনফিউশনের মাধ্যমে কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি অন্তর্ভুক্ত। কিছু ক্ষেত্রে এই জাতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি টিউমারকে যথেষ্ট সংকুচিত করে অস্ত্রোপচারের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে পারে।

উন্নত মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সার: উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি এবং/অথবা রেডিয়েশন থেরাপি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। 

 

পুষ্টিকর পরিপূরক 

লিভার ক্যান্সারের জন্য বিশেষভাবে সুপারিশকৃত কোনো পুষ্টির পরিপূরক নেই। লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা এবং শরীরে পানিশূন্যতা রোধ করা জরুরী। এ উদ্দেশ্যে জুস জাতীয় পানীয়, যেমন- আঙ্গুরের রস এবং সবুজ চা এড়িয়ে চলা ভালো। মুরগী, মাছ, ডিমের মতো চর্বিহীন আমিষ; কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য এবং বাদাম উপকারী খাবার হতে পারে। গম, রাই, বার্লি, ওটস এবং ব্রাউন রাইসের মতো পুরো শস্য; ফল এবং সবজি খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয় এ সময়। যাবতীয় মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং লাল মাংস খাওয়া সীমাবদ্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ। 

 

তথ্যসূত্র:

১. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6024033

 


Fighting Cancer Desk
ফাইটিং ক্যান্সার ডেস্ক